সরকারি হরগঙ্গা কলেজের ইতিহাস
মুন্সীগঞ্জ জেলার টঙ্গীবাড়ী উপজেলার ধীপুর ইউনিয়ন এর রাউতভোগ গ্রাম এর শ্রী আশুতোষ গাঙ্গুলী নামের এক মহৎ হৃদয়ের ব্যক্তি এই জনপদের শিক্ষা বিস্তারের জন্য অত্র অঞ্চলে একটি মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি তার লক্ষ্য পূরণের জন্য তদানীন্তন উপবিভাগীয় প্রশাসন এবং ধনিক শ্রেণীর নিকট সহায়তা কামনা করেছিলেন। কতিপয় শিক্ষাবিদ বিশেষ করে স্থানীয় আইনজীবি শ্রী সতীশ চন্দ্র ভট্টাচার্য, তদানীন্তন মুন্সীগঞ্জ মহকুমার উপবিভাগীয় ম্যাজিষ্ট্রেট জনাব এ.এইচ.এম ওয়াজির আলী (শেরে বাংলা ফজলুল হকের ভাগ্নে এবং জামাতা যিনি পরবর্তীকালে পদোন্নতি পেয়ে উপবিভাগীয় বিচারক হয়েছিলেন) প্রমূখ তাঁকে আন্তরিকতার সঙ্গে এই কাজে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এই মহাবিদ্যালয়টি শ্রী আশুতোষ গাঙ্গুলীর এক লক্ষ রুপী অনুদানের ফলে এবং তার মহানুভবতার কারণে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই কলেজটির নাম হরগঙ্গা কলেজ রাখা হয় শ্রী আশুতোষ গাঙ্গুলীর পিতা শ্রী হরনাথ গাঙ্গুলী এবং মাতা গঙ্গাশ্বরী দেবীর নামের প্রথম অংশ অনুসারে। ১৯৩৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর তারিখ ব্রিটিশ রাজের অধীনে অবিভক্ত বাংলার (ভারতবর্ষের অন্তর্ভূক্ত) তৎকালীন মূখ্যমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক কলেজটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন । আনুষ্ঠানিক শিক্ষাকার্যক্রম শুরু হয়েছিল ১৯৩৯ সালে। কলেজটির প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন শ্রী বিরেন্দ্র মুখার্জী। যিনি কলকাতার বিখ্যাত প্রেসিডেন্সী কলেজে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোসের সমসাময়িক ছিলেন।
কলেজটিতে ১৯৪১ সাল থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত কর্মমুখী শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা চালু ছিল। ১৯৪১ সালে কলেজের গ্রন্থাগারে প্রতিষ্ঠাতা শ্রী আশুতোষ গাঙ্গুলীর মার্বেল পাথরের একটি মূর্তী স্থাপন করা হয় এবং ১৯৪২ সালে তাঁর নামানুসারে কলেজ এর অডিটোরিয়াম এর নামকরণ করা হয়। শ্রী গাঙ্গুলী তাঁর পূর্বের অনুদানকৃত অর্থের চেয়ে দশ হাজার রুপি বেশি প্রদান করেছিলেন। ১৯৪২ সালে একটি সুরম্য তিনতলা ছাত্রাবাস কলেজ পুকুরের উত্তর দিকে নির্মাণ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে মোহাম্মদ আলী সিনহা যিনি লৌহজং উপজেলার কলমা অঞ্চলের অন্তর্গত ডহরি গ্রামের একজন হৃদয়বান ব্যক্তি ছিলেন, তিনি মুসলমান শিক্ষার্থীদের আবাসিক সুবিধার জন্য দশ হাজার রুপি অনুদান প্রদান করেছিলেন। সেই অর্থ দিয়ে কলেজ পুকুরের দক্ষিণ পার্শ্বে অবস্থিত মুন্সীগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের পুরাতন ছাত্রাবাসটি ক্রয় করার পর সেই স্থানে মো: আলী সিনহার নামে ছাত্রদের জন্য একটি ছাত্রাবাস নির্মাণ করা হয়েছিল। স্বাধীনতার পূর্বে এই আবাসনটিতে শিক্ষকরা বসবাস করতেন। বর্তমানে এই আবাসনটির কোন অস্তিত্ব নেই। তবে উক্ত স্থানে সরকারি অনুদানের একটি দ্বিতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। যেটি এখন ছয়টি স্নাতক বিভাগের শ্রেণীকক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
১৯৬২ সালে এই মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ এবং স্বনামধন্য নাট্যকার আযীম উদ্দিন আহমেদ (যিনি বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র খ্যাত প্রফেসর আব্দুল্লাহ আবু সাঈদের পিতা) কলেজের পুকুরের পশ্চিম পাড়ে একটি মসজিদ এবং পূর্বপাড়ে একটি ব্যায়ামাগার স্থাপন করেছিলেন। বর্তমানে ঐ ব্যয়ামাগারটির কোন অস্তিত্ব নেই। ১৯৬৬ সালে সরকারি অনুদানে কলেজের মূল ফটকের বিপরীতে অধ্যক্ষের বাসভবন নির্মিত হয় তৎকালীন অধ্যক্ষ জি. এম. এ মান্নান এর তত্ত্বাবধানে। অতঃপর ১৯৮০ সালের ১লা মার্চ কলেজটি জাতীয়করণ করা হয়। ২০০০ সালে অধ্যক্ষ প্রফেসর জীতেন্দ্র লাল বড়ুয়ার সময়ে কলেজ পুকুরের দক্ষিণ প্রাঙ্গনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর নামে একটি ত্রিতল একাডেমিক ভবন নির্মাণ করা হয়েছিল। ইতিপূর্বে ১৯৯৫ সালে পুকুরের পশ্চিম পাড়ে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এর নামে ১০০ শয্যা বিশিষ্ট একটি চারতলা ছাত্রাবাস নির্মাণ করা হয়। পরবর্তীকালে ২০০৭ সালে কলেজ মাঠের পশ্চিম দিকে পুরাতন একতলা বিজ্ঞান ভবনটি ভেঙ্গে সেই স্থানে স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর নামে একটি দ্বিতল বিজ্ঞান ভবন এবং কলেজের উত্তর দিকের সীমানায় তাপসী রাবেয়া বসরী নামে একটি ছাত্রী নিবাস নির্মাণ করা হয়। অধ্যক্ষ প্রফেসর আয়েশা শিরিন এর উদ্যোগে ২০০১ সালে কলেজ প্রাঙ্গনে “মাতৃছায়া” নামে তিনটি ছাতা নির্মিত হয়েছিল। যেগুলো কলেজ ক্যাম্পসের সৌন্দর্য অনেকখানি বাড়িয়ে দিয়েছে। ইতিমধ্যে কলেজ প্রাঙ্গনের উত্তরদিকে এবং অধ্যক্ষের বাসভবনের পূর্বদিকে অবস্থিত পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে কলেজের মসজিদ কমিটির তত্ত্বাবধানে একটি জামে মসজিদ নির্মাণ করা হয়। মসজিদটি নির্মাণ কাজে কলেজের ছাত্র-ছাত্রীবৃন্দ, শিক্ষকমন্ডলী, কর্মচারীবৃন্দ, স্থানীয় নেতৃবৃন্দ এবং সাধারণ মানুষ আর্থিক সহযোগিতা করেছেন। ২০০৪ সালে তৎকালীন অধ্যক্ষ প্রফেসর মেহেরুন নেসা ও উপাধ্যক্ষ প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক হাওলাদার এর সার্বিক উৎসাহে মসজিদটির নির্মাণ পরিকল্পনা করা হয় এবং মসজিদ নির্মাণে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেয়া হয়। এসময়ে পুকুরটির দক্ষিণ পার্শ্ব পাইলিং ও বালু ভরাটের কাজ শুরু হয়। পরবর্তীতে ২০০৬ সালে তৎকালীন অধ্যক্ষ প্রফেসর মোঃ মহিউদ্দিন মিয়াজীর সময়ে মসজিদটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে ২০০৮ সালে অধ্যক্ষ প্রফেসর মোজাম্মেল হক এর সময়ে শেষ হয়। ২০০৮ সালে বংলাদেশ সরকারের তদানীন্তন প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দিন আহমেদ ছাত্রদের যাতায়াতের সুবিধার্থে তার ব্যক্তিগত তহবিল থেকে ৫২ আসন বিশিষ্ট একটি বাস প্রদান করেন। ২০০৯ সালে গাড়িটি রাখার জন্য একটি গ্যারেজ নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে কলেজের দ্বিতল বিজ্ঞান ভবনটি চারতলা করার কাজ শুরু হয়েছে। এছাড়া পুরাতন ছাত্রাবাসের স্থানে ২০০ শয্যা বিশিষ্ট একটি ছাত্রাবাস এবং মূলভবনের পেছনে পাঁচতলা বিশিষ্ট একটি একাডেমিক ভবন নির্মাণের জন্য সরকারি অনুমোদন পাওয়া গেছে। স্বল্প সময়ের মধ্যে এ নির্মাণ কাজ শুরু হবে।
বর্তমানে কলেজটিতে একাদশ এবং দ্বাদশ শ্রেণিতে দুই হাজার তিনশত জন শিক্ষার্থী, স্নাতক (পাস) শ্রেণিতে ৯৫০ জন শিক্ষর্থী, বিভিন্ন স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে ২৬৫০ জন শিক্ষর্থী জন শিক্ষার্থী এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ে তিনশত জন শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে। এই কলেজের বর্তমান শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৭৪০০। ২০০২-২০০৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে উচ্চ-মাধ্যমিক শ্রেণিতে কম্পিউটার শিক্ষা বিষয় চালু করা হয়েছে। কলেজটিতে ১৯৯৫-৯৬ শিক্ষাবর্ষে বাংলা, ইংরেজি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান এবং হিসাববিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) কোর্স চালু হয় এবং ১৯৯৭-৯৮ শিক্ষাবর্ষে অর্থনীতি, সমাজকর্ম, রসায়ন, প্রাণিবিজ্ঞান এবং ব্যবস্থাপনা বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) কোর্স চালু হয়। ১৯৯৯-২০০০ শিক্ষাবর্ষে কলেজটিতে ইংরেজি, বাংলা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান এবং হিসাববিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতকোত্তর কোর্স চালু হয়। পরবর্তীকালে ২০০১-২০০২ শিক্ষাবর্ষে সমাজকর্ম বিষয়ে স্নাতকোত্তর কোর্সে চালু করা হয়। এছাড়া ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, দর্শন ও গণিত বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) কোর্স চালু হয়। বর্তমানে কলেজটিতে চৌদ্দটি বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) এবং সাতটি বিষয়ে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে অধ্যয়ন এর সুবিধা রয়েছে।